শিরোনাম

মেসি এবারই কি পরতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের সোনালি মুকুটটা?

সময়টা ২০০৬ সাল। বিশ্বজুড়ে বিশ্বকাপের উন্মাদনা। বরাবরের মতোই বাংলাদেশেও বিশ্বকাপের পারদ তখন তুঙ্গে। সেই সঙ্গে আকাশি-সাদা জার্সির লক্ষকোটি সমর্থকের একবুক প্রত্যাশা। ম্যারাডোনা-পরবর্তী আরেকটি সোনালি ট্রফি জয়ের স্বপ্ন। প্রতিবারের মতো আর্জেন্টিনার তারকাবহুল দলের দিকে ইগলের চোখ ভক্ত-সমর্থকদের। তবে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর সঙ্গে ম্যাচে সবার নজর কেড়ে নেন একজন তরুণ ফুটবলার। বদলি হিসেবে খেলতে নামা ছোটখাটো গড়নের তরুণ সেই ফুটবলার সেই ম্যাচে বদলি হিসেবে খেলতে নামে। কিন্তু মাঠে নামার পর হঠাৎ করে গ্যালারির আকর্ষণ কেড়ে নেয় তরুণ ফুটবলারটি। চমৎকার একটি গোলে এসিস্ট করে আর্জেন্টাইন ভক্তদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। এরপর নিজেই করে বসেন এক দুর্দান্ত গোল। ব্যস, গল্পটা সেখান থেকেই শুরু। এক খুদে জাদুকরের জাদুর গল্প শুরু। যে জাদুকরের নাম লিওনেল মেসি। 

২০০৬ বিশ্বকাপে বিশ্ববাসীর সুনজরে আসা মেসি সেবার দলের ব্যর্থতার চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে ফিরে যায়। তবে যাত্রাটা সেখান থেকেই শুরু। যদিও কথাটা ভুল হবে। কারণ মেসির যাত্রাটা তত দিনে ইউরোপসেরা ক্লাব বার্সেলোনা থেকেই শুরু হয়ে গেছে। তত দিনেই বার্সেলোনার জুনিয়র দলের তারকা বনে গেছেন মেসি। যাকে প্র্যাকটিস করতে দেখে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে সামান্য টয়লেট টিস্যু পেপারে সই নিয়ে চুক্তি করিয়েছিলেন বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট। সময়টা তখন ২০০০ সাল। হরমোন জটিলতায় ভোগা সেই ১৩ বছরের ছোট্ট মেসির জীবন নিয়েই ছিল শঙ্কা। তবে খেলতে ভালোবাসত। সেই মেসিকেই দলে ভেড়ায় বার্সেলোনা ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তার চিকিৎসা খরচ বহন থেকে শুরু করে তিলে তিলে গড়ে তোলা হয় তাকে। খুদে সেই ফুটবলার ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অদম্য এক চিতা বাঘ। বার্সেলোনা জুনিয়র দলের গণ্ডি পেরিয়ে তত দিনে মেসি মূল দলের নিয়মিত সদস্য হওয়া শুরু করেছেন। বিশ্বখ্যাত ফুটবলার রোনালদিনহো তখন বার্সেলোনার মূল তারকা। যার পায়ের জাদুতে মুগ্ধ গোটা বিশ্ব। রোনালদিনহোর রাজত্বে এক নতুন রাজপুত্রের আগমন ঘটল বার্সায়। মেসি নামের সেই রাজপুত্রের পরের ইতিহাস গোটা বিশ্ব জানে।
দেখতে দেখতে এলো ২০১০ বিশ্বকাপ। তত দিনে মেসি বিশ্বের সেরা ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। ফিফা ব্যালন ডি অর জয় করে ফুটবলের শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছেন। ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েছেন অলিম্পিকের স্বর্ণ। বার্সেলোনার হয়ে একের পর এক রেকর্ড করেই যাচ্ছেন। গোটা ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বের কাছে মেসি এক আতঙ্কের নাম! সারা বিশ্বের চোখ তখন মেসির দিকে। কারণ তত দিনে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন ফুটবলের ঈশ্বরখ্যাত ডিয়েগো ম্যারাডোনা। গুরু-শিষ্যের এক মহা যুগলবন্দি এবং উজ্জীবিত আর্জেন্টিনার প্রতি ঝুঁকল বিশ্ববাসী। ২০১০ বিশ্বকাপের শুরুটা শুধুই আর্জেন্টিনাময়। আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে অলিগলির সমর্থক, সবার চোখেই দুটি নাম, মেসি-ম্যারাডোনা। ২০১০ সালের আফ্রিকার বিশ্বকাপের শুরুর আগে লিওনেল মেসি নামের যে উষ্ণ পারদ ছড়িয়েছিল, ফুটবলের ইতিহাসে আর কোনো ফুটবলারকে নিয়ে এত আয়োজন, এত আলোচনা, এত কৌতূহল, এত স্বপ্ন দেখা হয়েছে বলে জানা নেই। বিশ্বকাপের শুরুটা ছিল শুধু মেসিময়। আন্তর্জাতিক মিডিয়া ছিল শুধু মেসিময়। গণমাধ্যম, টিভি চ্যানেল, রেডিও কিংবা বিশ্বকাপের মাঠ, একটাই নাম বারবার উচ্চারিত হতে লাগল। মেসি, মেসি, মেসি! তবে শুরুটা শুধু মেসিময় হলেও শেষটা মেসিময় ছিল না। মেসি-ম্যারাডোনা জুটির সেই জাদু ব্যর্থ হয়ে রয়ে গেল ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনাদায়ক এক অধ্যায় হিসেবে। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ ব্যবধানে হেরে বিদায় নিল আকাশি-সাদার একবুক স্বপ্ন। বিশ্বের এক নম্বর ফুটবলার মেসি ফিরলেন খালি হাতে। আর্জেন্টিনার হয়ে এত অর্জন যার, সেই ম্যারাডোনা ফিরলেন খালি হাতে। এর পরের গল্পও অবশ্য সবার জানা। নিজেকে আরো উজ্জীবিত করে বার্সেলোনায় ফিরলেন মেসি। তারপর একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলেন। ইউরোপের সব ক্লাবের জন্যই মেসি হয়ে উঠলেন মুর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। একের পর এক রেকর্ড ভেঙেচুরে নিজেকে আসীন করলেন সেরাদের কাতারে। 

দেখতে দেখতে ২০১৪ সাল। তত দিনে ফুটবল বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে চারটি ব্যালন ডি অরের মালিক তিনি। ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে হ্যাটট্রিকসহ টানা চারটি ব্যালন ডি অর জয় করে সেই ছোট্ট রাজপুত্র মেসি তত দিনে ফুটবল সাম্রাজ্যের যুবরাজ। যে যুবরাজের মাথায় বিশ্বকাপের সোনার মুকুট দেখতে উৎসুক গোটা দুনিয়া। এবার মেসির জোয়ার যেন বাঁধ ভেঙে দিল সব কিছুর। ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তারকা হিসেবেই এলেন ২০১৪ সালে ব্রাজিলে আয়োজিত বিশ্বকাপের মুকুট ছিনিয়ে নিতে। বিশ্বজুড়ে উন্মাদনা। এবার কি পারবে মেসি ২৮ বছরের শিরোপা খরা ঘুচাতে? বিশ্বজুড়ে উন্মাদনা যে দলটিকে ঘিরে, সেই দলটিকে তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে? পাহাড় সমান চাপ নিয়ে ব্রাজিলের মাটিতে তারকায় ঠাসা এক সেনাদল নিয়ে নামলেন মেসি। তার সেনাবহরে বিশ্বের সব নামিদামি তারকা। সের্হিও আগুয়েরো, ডি মারিয়া, হিগুয়াইন, তেভেজ, মাসচেরানো- সবাই বিশ্ব ফুটবলের জনপ্রিয় তারকা ফুটবলার। এই তারকাবহর নিয়ে প্রথম ম্যাচ থেকেই বুঝিয়ে দিলেন মেসি, এবার আর খালি হাতে ফিরছেন না তিনি। গ্রুপ পর্ব থেকে অপরাজিত হয়েই উঠলেন ফাইনালে। সোনালি ট্রফিটা ছুঁয়ে নিজেকে মহারাজা ঘোষণা করার মাত্র এক হাত দূরে মেসি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের ঘর থেকেই বিশ্বকাপের মুকুট নিয়ে ফিরবেন ফুটবলের অঘোষিত যুবরাজ মেসি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে আবারও হৃদয় ভাঙল মানুষটার। ফাইনালে অপ্রতিরোধ্য জার্মানি অপরাজিত আর্জেন্টিনার কাছে প্রায় ধরাশায়ী হয়েও মুহূর্তের মধ্যেই বদলে গেল দৃশ্যপট। ৯০ মিনিটের খেলা পেরিয়ে অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের ২২ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টিনার হৃদয় ছিঁড়ে বল ঢুকে গেল জালে। জার্মানির মারিয়া গোটজের সেই গোলটি কেড়ে নিল কোটি কোটি ভক্তের স্বপ্ন। ইতিহাস রচিত হলো ভিন্ন নামে। মেসি রয়ে গেলেন খালি হাতে, বুক ভাঙা এক সাগর আর্তনাদে মাথা নোয়ালেন নিজের। নিজে খেলেছেন, দলকে খেলিয়েছেন। ফাইনালে তুলেছেন আর্জেন্টিনাকে। টুর্নামেন্টে ৪ গোলসহ ৫টি ম্যাচে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হয়ে সেবার টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার অর্জন করে নামের প্রতি সুবিচার করলেও দেশের প্রতি দায়িত্বটা অধরাই রয়ে গেল। অথচ ইতিহাসটা অন্য রকম হতে পারত! আরেকবার স্বপ্ন ভাঙার ধাক্কা সইতে পারলেন না ফুটবলের যুবরাজ। গোটা বিশ্বকে কাঁদিয়ে ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে নিলেন তিনি। জাতীয় দলের জার্সি খুলে ফেললেন শরীর থেকে। মেসির এমন সিদ্ধান্তে হাহাকার ওঠে বিশ্বজুড়ে। স্বয়ং আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট অনুরোধ করেন মেসিকে অবসরের ঘোষণা প্রত্যাহার করার। গোটা বিশ্বের ভক্তকুল অশ্রুসিক্ত চোখে বারবার অনুরোধ করতে থাকে ফুটবলের যুবরাজকে ফিরে আসার। অবশেষে দেশ ও ভক্তদের অশ্রুকে সম্মান জানিয়ে আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে জড়ান মেসি। 
মেসি ফিরলেন। আবার ফিরলেন চিরচেনা রূপেই। সেই বার্সেলোনা আর অপ্রতিরোধ্য মেসি। একের পর এক রেকর্ড ভেঙেচুরে নিজেকে পাহাড় সমান উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। বার্সেলোনার সর্বকালের সর্বসেরা গোলদাতা হওয়ার পথে নিজেকে যেমন এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তেমনি দলকেও নিয়ে গেছেন পরপর দুটি কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টের ফাইনালে। তবে ভাগ্য সহায় হয়নি। জাতীয় দলের হয়ে তাঁর অর্জনটা যেন অসম্পূর্ণই থেকে যাচ্ছে! ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পরপর দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠেও আর্জেন্টিনার চেয়ে কম শক্তির দল চিলির কাছে হারতে হয়েছে মেসিবাহিনীকে। মেসির হৃদয়ে আক্ষেপের ঝড় বয়েই যাচ্ছে শুধু। যে মানুষটার নাম শুনলেই মাথা নোয়ায় গোটা পৃথিবী, সেই মানুষটা কিনা আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে একটি আন্তর্জাতিক ট্রফিই তুলে ধরতে পারছেন না! প্রকৃতির এমন অবিচার যেন মেনে নেওয়া যায় না!

দেখতে দেখতে ২০১৮ সাল। তত দিনে মেসির ঝুলিতে বিশ্বের বেশির ভাগ রেকর্ড, ট্রফি। শৌর্যে, সম্মানে, বীরত্বে লিওনেল মেসি তখন বিশ্বের অদ্বিতীয় একজন। ফুটবল সাম্রাজ্যের অঘোষিত মহারাজা। পাঁচটি ব্যালন ডি অর এবং ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে সম্ভাব্য সব ট্রফিই তার শোকেসে সাজানো। এবারও তারকাবহুল দল নিয়ে রাশিয়ায় পাড়ি জমালেন মেসি। বিশ্বজুড়ে আবারও আকাশি-সাদার উন্মাদনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এবার মেসি নিজেও নিষ্প্রভ! যেন ছন্দ হারিয়ে ফেলেছেন জাদুকর! গোটা টুর্নামেন্টে মাত্র একটি গোল মেসির! তারপর নকআউট পর্বে ফ্রান্সের কাছে স্বপ্নভঙ্গ। শুরুতে এগিয়ে থাকা ম্যাচেও শেষ পর্যন্ত ৪-৩ গোলের পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে মেসির আর্জেন্টিনা। না, এবার আর ভেঙে পড়েননি। তত দিনে মেসি নিজের কান্না লুকাতে শিখে গেছেন। এবার নিজেকে নতুন করে গড়ার শপথ নিলেন আপনমনে। খালি হাতে ফিরলেন মেসি। এরপর ২০১৯ সালে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছে পরাজিত হয়ে আরেকবার স্বপ্ন ভঙ্গ মেসির! তবে কি জাতীয় দলের হয়ে একটি আন্তর্জাতিক ট্রফি ছুঁয়ে দেখা হবে না তার? এ কেমন বাধা? কিসের বাধা? এ কেমন দেয়াল, যা ভাঙতে পারছেন না ফুটবলের মহারাজা! যার পায়ের নিচে ফুটবল সাম্রাজ্য ঠাঁই নিয়েছে, তিনিই কিনা আকাশি-সাদা জার্সিতে একটি ট্রফি ছুঁয়ে দেখবেন না? 

না, ছুঁয়ে তিনি দেখেছেন। সেই কোপার ট্রফিই ছুঁয়েছেন। ব্রাজিলের মাঠেই ছুঁয়েছেন। ২০২১ সালে ব্রাজিলের মাঠে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছর পর কোপা আমেরিকার মূল্যবান ট্রফি ঘরে তোলেন মেসি। কাটালেন জাতীয় দলের হয়ে নিজের শিরোপা খরা। তত দিনে মেসির আর্জেন্টিনা এক অপ্রতিরোধ্য নাম ফুটবল বিশ্বে। অপরাজিত থেকেই কোপা জয় করে ফিরলেন মেসি। ব্যস, এক ভিন্ন গল্পের শুরু হলো আবার। মাঝে কিছুটা আঘাত পেয়েছেন ক্লাবের হয়ে। যে ক্লাবকে সারা জীবন ভরে শুধুই দিয়ে গেছেন দুই হাত ভরে, সেই বার্সেলোনা শেষ পর্যন্ত তার নামের সঙ্গে সুবিচার করতে পারেনি। অশ্রুসিক্ত চোখেই বিদায় নিতে হয়েছে তাকে ক্লাব থেকে। তত দিনে তিনি বার্সেলোনার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। দীর্ঘ ২১ বছরের সুবিশাল যাত্রায় বার্সেলোনার হয়ে সব ধরনের ট্রফি আর ইতিহাস তৈরি করে ৬টি ‘ব্যালন ডি অর’ নিয়ে পাড়ি জমালেন ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে। রাজকীয় এক সংবর্ধনায় আপন করে নেওয়া হলো মেসিকে। এমন রাজকীয় সংবর্ধনা ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে দেখেনি কেউ। তবে নতুন ক্লাবে মানিয়ে নিতে কিছুটা সমস্যায় ভুগলেও জাতীয় দলের হয়ে মেসি নিজেকে প্রমাণ করতে লাগলেন বারবার। কোচ স্কালোনির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি এক ছক কষে দিনদিন আর্জেন্টিনাকে গড়তে লাগলেন ইস্পাতের মতো মজবুত করে। মেসি-স্কালোনি জুটি হয়ে উঠলেন আর্জেন্টিনার ত্রাণকর্তা। তত দিনে জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডও তার দখলে। ম্যারাডোনা নামক সম্রাটকে টপকে আর্জেন্টিনা এখন মেসির রাজত্বে। 
সময় পেরিয়ে ২০২২ সাল। বিশ্বকাপের বছর। ২০১৯ সাল থেকেই অপরাজিত থেকে সর্বশেষ কোপা জয় করে অবশেষে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে প্রবেশ করল মেসির আর্জেন্টিনা। টানা ৩৬ ম্যাচ ধরে অপরাজিত মেসির আর্জেন্টিনার সামনে এখন আর ভয় আর ব্যর্থতা নামক শব্দ নেই। আছে শুধুই স্বপ্ন। তবে বিশ্বকাপের শুরুতেই হোঁচট খেল মেসির আর্জেন্টিনা। অপ্রতিরোধ্য আর্জেন্টিনাকে মাটিতে নামিয়ে আনলেন সৌদি আরবের মতো এক ফুটবল দল। তবে আবারও হাল ধরলেন মহারাজা মেসি। এখন তিনি সইতে পারেন, ঘুরে দাঁড়াতেও পারেন। সৌদির সাথে হারের পর আর্জেন্টিনাকে নতুন করে উজ্জীবিত করলেন মেসি। তারপর মেক্সিকোর সাথে জয়ের পর ভক্তদের উদ্দেশে বললেন, ‘ভরসা রাখুন আমাদের ওপরে। আমরা পারব।’ হ্যাঁ, মেসি পেরেছেন। আর্জেন্টিনা পেরেছে। আবারও চিরচেনা ছন্দে ফিরে একে একে মেক্সিকো ও পোল্যান্ড, নকআউটে অস্ট্রেলিয়া এবং কোয়ার্টার ফাইনালে নেদ্যারল্যান্ডসকে পরাস্ত করে অবশেষে সেমিফাইনালে পা দিয়েছে মেসির আর্জেন্টিনা।
আজ ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে সেমিফাইনালে মাঠে নামবেন মেসি। হতে পারে এটাই মেসির স্বপ্নপূরণের পথে শেষ সিঁড়ি! আজ ক্রোয়েশিয়াকে পরাজিত করলে ফাইনালে ফ্রান্স কিংবা মরক্কোর মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ কে, সেটা নিয়ে হয়তো মেসি আর ভাবেন না। কারণ মেসি এখন অনেক ভাবনার ঊর্ধ্বে  নিজেকে আসীন করেছেন। এক জীবনে অনেক ক্ষত বুকে নিয়েই নিজের সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়েছেন। ভক্ত-অনুরাগীদের সব আক্ষেপ-হতাশাকে রূপ দিয়েছেন সাফল্য, ভালোবাসায়। শেষ মুহূর্তে এসে কি মেসি পারবেন না নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা পূরণ করতে? হয়তো পারবেন। কারণ আগে আর্জেন্টিনা নামক দলটির একটিই মেসি ছিল। এখন ১০ জন মেসি একসাথে মাঠে নামেন লিওনেল মেসির জন্য। যে এক মেসিতেই দেড় যুগ কুপোকাত ছিল ফুটবল, সেই মেসির জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া বাকি ১০ জন মেসিকে আটকানো কি সম্ভব আদৌ? হয়তো সম্ভব না। আর্জেন্টিনা এখন সমন্বিত একটি দল। এবারের আর্জেন্টিনা প্রতিবারের মতো এতটা তারকা খচিত নয়। সাদামাটা এক দল নিয়েই মেসির শেষ লড়াইটা শুরু। তবে এই দলটা মেসির নিজের হাতে গড়া, নিজের মতো করে তৈরি এক প্রকৃত যোদ্ধার দল। মেসির জীবনের শেষ যুদ্ধে, শেষ যাত্রায় এবার তার সেই সতীর্থরা মেসির হাতে একটি বিশ্বকাপের ট্রফি তুলে দিতে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত। তবে কি মেসির হাতের স্পর্শ পেতে যাচ্ছে চির অধরা বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা? প্রকৃতিও হয়তো এটাই চায়। তাইতো গল্পগুলো বদলে যাচ্ছে একের পর এক। অপূর্ণতার শেকলে বন্দি আর্জেন্টিনা ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যা কিছু ছিল এত দিন স্বপ্নের মতো, তার সব কিছুই এখন চোখের সামনে দৃশ্যমান। অপরাজিত আর্জেন্টিনা, মেসির কোপা জয়, ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনার কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়, বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে হারের পরেও নায়কের বেশে সেমিতে পৌঁছানো! এ যেন একের পর এক রূপকথার গল্প! তাই এই আর্জেন্টিনার শেষটাও হবে রূপকথার মতোই সুন্দর।

দীর্ঘ ১৭ বছরের রাজকীয় ক্যারিয়ারে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির ফুটবলার, ইতিহাসের সেরা ড্রিবলার, ক্লাবের হয়ে শীর্ষ গোলদাতা (৬৮৭ গোল, বার্সেলোনা), ক্লাবের হয়ে সর্বাধিক ১১টি শিরোপা, ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি, সর্বকালের সবচেয়ে বেশি ট্রফিজয়ের তালিকায় দ্বিতীয় (৪১টি), সর্বাধিক গোল্ডেন বুট জয় (৬টি), এক বর্ষপঞ্জিকায় সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৯১), আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা (৯৫), পেলে-ম্যারাডোনাকে টপকে লাতিন আমেরিকার সর্বোচ্চ গোলদাতা (৮০), সর্বকালের সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি অর (৭টি) ও ফুটবলের ইতিহাসে সর্বাধিক সময়কাল ধরে শীর্ষস্থান ধরে রাখাসহ শত শত বিশ্বরেকর্ডে নিজের নাম লিখিয়ে লিওনেল মেসি ফুটবলের যুবরাজ থেকে তিলে তিলে হয়ে উঠেছেন পরাক্রমশালী মহারাজা। তাই লিওনেল মেসির শেষটাও হবে রাজকীয় পরিপূর্ণতায় পরিপূর্ণ, এমনটাই প্রত্যাশা ফুটবল বিশ্বের। অপেক্ষা শুধু অল্প কিছু মুহূর্তের। ফুটবলের মহারাজার মাথায় উঠবে বিশ্বকাপের সোনালি মুকুটটা, অপেক্ষা শুধু সেই রাজকীয় মুহূর্তটির!
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ

আরও দেখুন

মিরপুর টেস্ট হেরে সিরিজ জেতা হলো না বাংলাদেশের

৬৯ রানে ৬ উইকেট নেই। বাংলাদেশের দেওয়া ১৩৭ রানের লক্ষ্যটা তখন নিউজিল্যান্ডের জন্য দূর আকাশের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *