লেখক: আবু কায়ছার মোঃ সাইফুল ইসলাম,
বৈদেশিক ক্রয়, ক্রয় বিভাগ,
তিতাস গ্যাস টি এন্ড ডি কোং লিঃ, ঢাকা:
জ্বালানী হচ্ছে কোন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। জ্বালানী ছাড়া কোন দেশের কোন কিছু, কোন ক্ষেত্র এমনকি সামান্য অংশও অগ্রগতি হতে পারে না- ইহা হতে পারে শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, স্বাস্থ্য , শিক্ষা ইত্যাদি। উন্নত দেশে যেতে রূপকল্প ২০৪১-এর রোডম্যাপ বা পথচিত্র তৈরি করেছে সরকার। আগামী ২০ বছরের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এমন সব সংস্কার কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে যার ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হবে। রূপকল্প ২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে গড়ে তোলার জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা। ২০২২ থেকে ২০৪৪ সাল, এই বাইশ বছরের কৌশলগত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে, বাংলাদেশের লক্ষ্য শিল্পায়নের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন।
বাংলাদেশ থেকে রফতানি বৃদ্ধি, মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের প্রসারকে উৎসাহ দেয়া রূপকল্প ২০৪১ -এর উদ্দেশ্য।ফলে ওই সময়ে- বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৯.৯ শতাংশ। মানুষের গড় মাথাপিছু আয় গিয়ে ঠেকবে সাড়ে ১২ হাজার ডলারে। চরম দারিদ্র্য বলতে কিছু থাকবে না। অর্থাৎ তা শূন্যে নেমে আসবে। মাঝারি দারিদ্র্যও কমে আসবে ৫ শতাংশের নিচে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের তৈরি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১-এর সারসংক্ষেপ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই সারসংক্ষেপে বলা হয়, উচ্চ প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে উঠে টেকসই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। এ জন্য প্রয়োজন ফলপ্রসূ করব্যবস্থা ও ব্যয় সংকোচন নীতিমালা। তার সঙ্গে যোগ হয় সঞ্চয়, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা, পরিবহন, বাণিজ্য, জ্বালানি ও গুণগত বিনিয়োগ। এর সঙ্গে আরো অনেক কিছুর মেলবন্ধন ঘটিয়ে গড়ে উঠে একটি উন্নত দেশের ভিত্তি। এ লক্ষ্যে চারটি প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ, বিকেন্দ্রীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। বলা হয়, এসবে ভর করেই এগোবে উন্নত বাংলাদেশ। আর তখন বর্তমানের কর-জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশ থেকে তা পৌঁছে যাবে ১৭ শতাংশে। এ লক্ষ্যে বাড়বে করের পরিধি, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমে প্রত্যক্ষ কর বিশেষ করে আয়কর ও ভ্যাট আদায় বাড়ানো হবে। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষকে বেশি আক্রান্ত করে। তাই ২০৪১ সালে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে। বাণিজ্য কাঠামোও ব্যাপকভাবে পরিবর্তন আনা হবে। পোশাক খাতে যেভাবে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, একই ভাবে অন্য খাতে প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণ শক্তিশালী করা হবে। উৎপাদন, বণ্টন থেকে শুরু করে জাহাজীকরণ পর্যন্ত সর্বস্তরে একটি সহজ, সুন্দর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হবে। বর্তমানে যেভাবে একটি শক্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়েছে, এ ধারা আরো শক্তিশালী করা হবে। বিনিয়োগকে ওই রূপকল্পেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তা গড়ে ৩৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়, উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে এটা করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কৃষি খাতে যে প্রবৃদ্ধির ধারা বিশেষ করে চালের যে উচ্চ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি তা আরো বেগবান করা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নেও বহুমুখী কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে সারসংক্ষেপে। দেশ যত উন্নত হবে, ক্রমেই কমে আসবে বাণিজ্য সুবিধা। বিশেষ করে শুল্কমুক্ত সুবিধা সংকুচিত হবে। কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পরিচর্যা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স ও থ্রি ডি মেটাল প্রিন্টিং প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এতে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান বাড়বে। রাজস্ব কর জিডিপির ১৫% পর্যন্ত বাড়ানো। রফতানি বৈচিত্র্য অর্জন।রফতানি আয় ৩০০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি করা।গড় আয়ু বাড়িয়ে ৮০ বছর করা।মোট জনসংখ্যার ৭৫% কে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা। ২০৪১ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ১০০% এ বৃদ্ধি করা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১% এরও নিচে নামিয়ে আনা। কার্যকর কর এবং ব্যয়ের নীতিমালা কার্যকর করা। অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তির বিকেন্দ্রীকরণ। ২০০৯ সাল হতে বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অর্জিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ২০১০ সালের ৫৮২৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮,৯৬১ মেগাওয়াটে। আগামী দিনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে অব্যাহতভাবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ৫১,০০০ মেগাওয়াট। একটি উচ্চ আয় দেশের জন্য টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি’ শীর্ষক অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত কৌশল মোতাবেক সে বছর ৫৬,৭৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। এ সময়ে বিদ্যুৎ খাতে যুক্ত হবে পারমাণবিক প্রযুক্তি। ২০৪১ সালে জ্বালানি বিন্যাস হবে ৩৫ শতাংশ গ্যাস, ৩৫ শতাংশ কয়লা, ১২ শতাংশ পারমাণবিক, ১ শতাংশ তরল তেল এবং ১ শতাংশ জলীয়। বাকি ১৬ শতাংশ করতে হবে আমদানি।
বর্ণিত উচ্চ আয়ের অর্থনীতি ও উচ্চ আয়ের দেশ, উচ্চমাত্রার জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধি অর্জন, রফতানিমুখী শিল্পায়ন, কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, নগরের বিস্তার, দক্ষ জ্বালানি ও অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি, ব্যাপক কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা অর্জন, দারিদ্রশূন্য বাংলাদেশ, জাতির পিতার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ‘দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতি ও শোষণহীন সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা কোনভাবেই সম্ভব নয় যদি পর্যাপ্ত, বাধাহীন প্রয়োজনীয়, সাশ্রয়ী এবং দক্ষ জ্বালানী ( গ্যাস, তেল, কয়লা,এলপিজি ইত্যাদি) সরবরাহ করা সম্ভব না হয়। জ্বালানী ছাড়া কোন সেক্টরের কোন কিছু উন্নয়ন সম্ভব নয়। এখানে উল্লেখ্য যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে অব্যাহত রাখতে ক্রমবর্ধমান জ্বালানীর যোগান অপরিহার্য বিবেচনা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট ব্রিটিশ তেল কোম্পানি শেল ওয়েল হতে ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র- তিতাস, হবিগঞ্জ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা ও বাখরাবাদ নাম মাত্র মূল্যে অর্থ্যাৎ ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড স্ট্যালিং মূল্যে ক্রয় করে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি The Esso Undertakings Acquisition Ordinance, 1975-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ESSO Eastern Inc.-কে সরকারীকরণ করে জ্বালানী তেলের মজুদ, সরবরাহ ও বিতরণে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জাতির পিতার এ যুগান্তকারী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে দেশে জ্বালানী নিরাপত্তার গোড়াপত্তন ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার রূপকল্প-২০৪১ অর্জনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে জ্বালানী খাতকে অগ্রাধিকার প্রদান করে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে সুন্দলপুর, শ্রীকাইল, রূপগঞ্জ, ভোলা নর্থ ও জকিগঞ্জ নামে মোট ৫টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।আরও নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য বর্তমানে ১০ হাজার লাইন কিলোমিটার ২-ডি সিইসমিক জরিপ এবং ১৫৫৩ বর্গকিলোমিটার ৩-ডি সিইসমিক জরিপ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।২০০৯ সাল হতে জুন ২০২২ পর্যন্ত ২১টি অনুসদ্ধান, ৫০টি উন্নয়ন ও ৫৬টি ওয়ার্কওভার কুপ খননের ফলে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০০০ এমএমসিএফডি। আমদানীকৃত এলএনজিসহ বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ দৈনিক ৩৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে।সারাদেশে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের উত্তারাঞ্চলে গ্যাস নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য গ্যাস বিতরণ লাইন স্থাপন এবং পায়রা বন্দরে Floating Storage & Regasification Unit (FSRU) স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২০৪১ সাল পর্যন্ত গ্যাসের চাহিদার উপর ভিত্তি করে মাতারবাড়িতে দৈনিক ১,০০০ ঘনফুট ক্ষমতার ১টি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে। জ্বালানী খাতকে আধুনিক ও ডিজিটালাইজড করার জন্য Enterprise Resource Planning প্রবর্তন এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্যাস ও কয়লার উৎপাদন বৃদ্ধিতে সর্বাত্নক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জ্বালানী চাহিদা পূরণে গ্যাস উত্তোলন, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ কয়লার মজুদ নির্ধারণ, আহরিত জ্বালানী সম্পদ ব্যবহারে নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত ও এ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রস্তুত এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন অব্যাহত রয়েছে। বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সার, শিল্প, গৃহস্থালি, সিএনজি, ব্যবসা-বাণিজ্যে বর্ধিত হারে গ্যাস সরবরাহের ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়ন ত্বরাম্বিত হয়েছে। জ্বালানী ঠিকমত যোগান দেয়া সম্ভব হওয়ায় ইতোপূর্বে দেশে ব্যাপক বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়েছে এবং সরকারের ওয়াদা অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্ভব হয়েছে। ইহা ছাড়াও গ্যাস অপচয়রোধ কল্পে ইতোমধ্যে ৪ লক্ষ আবাসিক গ্রাহকের প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে এবং আরও স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের জন্যে ইতোমধ্যে Future Road Map for Power and Energy Sector প্রস্তুত করা হয়েছে- এর মধ্যে Power Sector Master Plan (PSMP) এবং Gas Sector Master Plan (GSMP)ও প্রস্তুত করা হয়েছে যা বাস্তবায়নাধীন আছে।
জ্বালানী খাত উন্নয়ণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এবং ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে সরকার যুগোপযোগী ও সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও বর্তমানে বৈশ্বিক অবস্থা, বিভিন্ন জ্বালানীর দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, কোভিড-১৯ মহামারী এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধের কারণে ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে সরকার বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ-এর সম্মূখীন হচ্ছে-
বাংলাদেশের জ্বালানী অনুসন্ধানের কার্যক্রমে পর্যাপ্ত গতি না থাকায় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং একমাত্র কয়লা খনির মজুদও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আমদানী নির্ভর জ্বালানী চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। গত বিশ বছরে প্রায় ১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে মাত্র ২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। বড় ধরনের রিজার্ভ আবিষ্কার না হলে এই বর্তমান গ্যাস রিজার্ভ ২০৩১ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানেও গতি নেই। মায়ানমার ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ ২০১২ সালে নিষ্পত্তি হলেও এতবছরে ও বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা যায়নি। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় ২৬টি তেল-গ্যাস ব্লক রয়েছে তার মধ্যে অগভীর অংশে ১১টি ও গভীর সাগরে ১৫টি। যদিও বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানি কনোকো ফিলিপস প্রাথমিকভাবে সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করলেও PSC (Production Sharing Agreement) চুক্তি তাদের মনমতো না হওয়ায় এবং তাদের চুক্তির রিভিশন কার্যকর না করায় তারা অনুসন্ধানে আকৃষ্ট হয়নি। বর্তমানে সরকার বিদেশী কোম্পানিসমূহকে গভীর সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আকৃষ্ট করতে পিএসসি চুক্তি সংশোধন করতে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের উৎপাদিত বিদ্যুৎ-এর ৫০-৭০% গ্যাস ভিত্তিক। বাংলাদেশের খনি হতে উৎপাদিত গ্যাস দেশের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানী করে গ্যাসের চাহিদা মিটাতে হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে প্রাথমিক জ্বালানী এলএনজি, কয়লা, ক্রুড ওয়েল, পেট্রোলিয়াম প্রডাক্টের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওযায় দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প ছাড়া অন্য খনিজ সম্পদ উত্তোলনে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। বড় পুকুরিয়া থেকে সর্বোচ্চ ৫-৬ বছর কয়লা উত্তোলন করা যাবে। রংপুরের খালাসপীর, জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ, দিনাজপুরের ফূলবাড়ী, রংপুরের মদনখালীতে উন্নতমানের কয়লা পাওয়া গেলেও অদ্যাবধি উত্তোলনের উদ্যোগ ঝুলে আছে। অথচ বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর অনেকগুলো কয়লাভিত্তিক। বর্তমানে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানী করা হচ্ছে। রামপাল, মাতারবাড়ী, বাঁশখালীতে বড় ধরণের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরী হচ্ছে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতে প্রাথমিক জ্বালানী গ্যাস, কয়লা, ক্রুড ওয়েল-এর দাম বহুগুনে বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিল জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের নিজস্ব রিসোর্স হতে তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশের Comprehensive Energy Policy-এর অভাব রয়েছে।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং জ্বালানী সংকট মোকাবেলায় তেল গ্যাস নিজম্ব উৎস থেকে উত্তোলন এবং অনুসন্ধানে গুরুত্ব দিতে হবে। খনিসমূহে কয়লা উত্তোলনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অগভীর-গভীর সমূদ্রে সংশোধিত পিএসসি অনুযায়ী দ্রুত বিডিং সম্পন্ন করে তৈল গ্যাস অনুসন্ধানে বহুজাতিক কোম্পানীকে দায়িত্ব দিতে হবে। জ্বালানী ও বিদ্যুৎ-এর value chain-এর দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুতের চুরি, সিস্টেম লস দূর করতে হবে। যেখানে সম্ভব প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানী, জ্বালানী মিশ্র, নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহার করতে হবে। বিকল্প উৎস থেকে দীর্ঘ মেয়াদী কন্ট্রাকের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহের জন্য আলোচনা করতে হবে ও প্রয়োজনীয় চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। জ্বালানী খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং উন্নত কাস্টমার সার্ভিস প্রদান করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি, ডিজিটাল সিস্টেম-এর গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া জ্বালানী খাতে জয়েন্ট ভেঞ্চার, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপ, বেসরকারী বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে হবে।বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে বিদ্যুৎ, জ্বালানী- তেল ও গ্যাসের সর্বোত্তম ও সাশ্রয়ী ব্যবহারে কোন বিকল্প নেই।
জ্বালানী ছাড়া কোন উন্নয়ন, লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বর্তমানে পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে জ্বালানীখাতের বর্ণিত চ্যালেঞ্জসমূহ দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষম হলে জ্বালানীখাতের দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা (ভিশন-২০৪১) বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। জ্বালানী খাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হওয়ার জন্য ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশ ক্ষুদা, দারিদ্রমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত হবে।