বিবিসির সংবাদদাতা জেরেমি বোয়েন দক্ষিণ ইসরায়েলের আশকেলন শহরের একটি হোটেলে অবস্থান করছেন। এই শহরটির ১০ কিলোমিটার দূরেই গাজা উপত্যকা।
ইসরায়েল সম্ভবত গাজায় ধীরগতির, তবে দীর্ঘমেয়াদি হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে, যা কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস ধরে চলতে পার। দি ইকোনমিস্টের প্রতিরক্ষা সম্পাদক শশাঙ্ক জোশি বিবিসির নিউজ আওয়ার প্রগ্রামকে এ কথা জানিয়েছেন।
জোশি বলেন, ‘আপনি যদি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো গাজার বড় বড় এলাকাগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন, তখন আপনার নিজেদেরই ওই রাস্তায় চলাচল করা কঠিন হয়ে উঠবে।’
এ ছাড়া হামাস তার কার্যক্রমের জন্য যে বিস্তৃত ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সেটাও ইসরায়েলের সেনাদের জন্য ‘খুব কঠিন’ বাধা বলে জোশি মনে করেন। যেহেতু টানেলের ভেতরে জিম্মিরা বন্দি আছে, তাই ইসরায়েলি সেনাদের পক্ষে সেখানে ‘অতর্কিত হামলা চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ হয়ে উঠতে পারে।
গাজায় টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাও ইসরায়েলি সেনাদের একটি কৌশল হতে পারে বলেও জোশি মনে করেন।
ইসরায়েলি স্থল বাহিনীর গাজায় তৎপরতা
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় স্থল অভিযানে জন্য তাদের সেনাদের প্রস্তুতি নেওয়ার বিভিন্ন ছবি পোস্ট করেছে। ছবিগুলো টুইটারের ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর অফিশয়াল অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত হয়।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শনিবার এক টেলিভিশন ভাষণে বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েল দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছে এবং গাজা উপত্যকায় সব সেনা ও কমান্ডার মোতায়েন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা লড়াই চালিয়ে যাব এবং আমরা আত্মসমর্পণ করব না। আকাশ বা স্থল কোথাও সেনা প্রত্যাহার করব না।’
ইসরায়েল জিম্মি মুক্তির প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে : কাতার
গাজায় গতকাল থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের স্থল অভিযান হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে বলে মনে করছে কাতার।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেছেন, ‘এই ক্রমবর্ধমান অভিযান পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এর আগে বলেছিলেন, হামাসকে সামরিকভাবে পরাজিত করা এবং জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনার মধ্যে ‘কোন দ্বন্দ্ব’ নেই।
ইসরায়েল নিশ্চিত করেছে, হামাস ২২৯ জনকে জিম্মি করে রেখেছে।
ইসরায়েল পাল্টা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে : রাইসি
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, ইসরায়েলের পদক্ষেপ ‘সব সীমা অতিক্রম করেছে, যা সবাইকে তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে’।
রবিবার টুইটারে এক বার্তায় রাইসি বলেন, ‘ওয়াশিংটন আমাদের কিছু না করতে বলে, নিজেরাই ইসরায়েলকে ব্যাপক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরোধী অক্ষের উদ্দেশ্যে যে বার্তা দিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রেই তারা এর জবাব পেয়েছে।’
প্রতিরোধী অক্ষ বলতে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরান সমর্থিত বাহিনীর একটি নেটওয়ার্ককে বোঝানো হয়, যার একটি অংশ হামাস। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে আসছে। কারণ তারা বড় আকারের আঞ্চলিক সংঘাত বন্ধের ব্যাপারে আগ্রহী। ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীও সাম্প্রতিক সপ্তাহে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
ফিলিস্তিনের টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ স্বাভাবিক
গাজায় চলমান বিমান হামলার মধ্যে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে যোগাযোগের সব ধরনের নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছিল। যা ওই অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণভাবে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে করে ফেলে। তবে রবিবার সকাল থেকে সেখানকার টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
প্যালেস্টাইন টেলিকমিউনিকেশন কম্পানি (প্যাল্টেল) এক টুইটে জানিয়েছে, ‘আমাদের টেকনিক্যাল টিম এমন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক অবকাঠামোর ক্ষতিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবে করছে।’
রিয়াল-টাইম নেটওয়ার্ক ডাটাতেও দেখা যায়, গাজা উপত্যকায় ইন্টারনেট সংযোগ পুনরুদ্ধার হয়েছে। ইন্টারনেট মনিটরিং গ্রুপ নেটব্লকস টুইটে যোগাযোগ পুনরুদ্ধারের কথা জানায়।
গাজার কিছু সাংবাদিকও টুইট করেছেন, তারা ফোন কল করতে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যকে প্রবেশ করতে পারছেন।
শনিবার বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক রেগেভ বিবিসির টুডে প্রগ্রামে শত্রুদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত করাকে ‘আদর্শ আচরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তার কাছে সরাসরি প্রশ্ন রাখা হয়, ইসরায়েল কি ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে? এর জবাবে, রেগেভ জানান, ‘আমি তা বলিনি। আমি শুধু বলেছি এটি পশ্চিমা, গণতান্ত্রিক সেনাবাহিনীর জন্য স্বাভাবিক উপায়।’
গাজায় গুদামে হামলা
গাজার হাজার হাজার বাসিন্দা গুদাম ও বিতরণকেন্দ্রগুলো ভেঙে ঢুকে পড়েছে এবং আটা ও অন্যান্য মৌলিক পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। গাজার দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে ঠিক কখন ও কোন গুদামে এই হামলা হয়েছ তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা (ইউএনআরডাব্লিউএ) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানায়।
ইউএনআরডাব্লিউএ বলছে, ‘গাজায় তিন সপ্তাহের যুদ্ধ ও কঠোর অবরোধের পর বেসামরিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে, যা বেশ উদ্বেগজনক। মানুষ ভীত, হতাশাগ্রস্ত এবং মরিয়া। ফোন ও ইন্টারনেট লাইন কাটা পড়ায় আরো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।’
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস বৃহস্পতিবার বলেছেন, গত সপ্তাহে গাজায় ত্রাণ ‘সবচেয়ে কম’ পৌঁছেছে, সে সময় ইসরায়েল তীব্র বোমাবর্ষণ করছিল।
এদিকে মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র রবিবার গাজায় মানবিক সহায়তা বাড়াবে বলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ এক টুইট বার্তায় জানিয়েছে। আইডিএফে মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি হামাসের বিরুদ্ধে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপরে গুলি চালানো এবং তাদের ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ তোলেন।
রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি গাজায় প্রাণহানির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে দ্রুত এই সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানায়।
৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় বোমা হামলা শুরু করে। গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলের পাল্টাহামলায় গাজায় আট হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথ্যমতে, সর্বশেষ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে তিন ফিলিস্তিনি নিহতের খবর পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে পশ্চিম তীরে শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি, Kalerkantho